<p>পুলিশের রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স (আরআরএফ) ঢাকা ইউনিটের প্রধান পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান তাঁর বাড়ি বানাতে খাটাচ্ছেন পুলিশ সদস্যদের। বছর দুয়েক আগে থেকে তিনি সাভারের হেমায়েতপুরের জগন্নাথপুরে প্রায় ৮৪ শতাংশ জায়গার ওপরে তৈরি করছেন আলিশান বাড়িটি। আর ওই কাজে জোগালি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে সাব-ইন্সপেক্টর থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদমর্যাদার প্রায় ৬০ জন পুলিশ সদস্যকে। তাঁদের মধ্যে আছেন কয়েকজন বয়স্ক সদস্য। মাত্র তিনজন পেশাদার রাজমিস্ত্রি তাঁদের সঙ্গে আছেন। নির্মাণসামগ্রী আনা-নেওয়ার কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে পুলিশের গাড়ি। রাজধানীর মিরপুরে ও পলাশেও তিনি বাড়ি বানাচ্ছেন পুলিশ সদস্যদের দিয়ে। বেশির ভাগ সময়ই এখন মিজানুর রহমান জগন্নাথপুরে কাটান। অফিস করেন খুব কম।</p> <p>গত মঙ্গলবার দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়েও পুলিশ সুপারের দেখা মেলে। দেখা জায় তিনি ‘পুলিশ শ্রমিকদের’ কাজের তদারকি করছেন। বাড়িটি চারতলা পর্যন্ত উঠে গেছে। এখন চলছে চারদিকে বাউন্ডারির কাজ। কয়েকজন পুলিশ সদস্য (পোশাক পরিহিত অবস্থায়) ঘোরাফেরা করছেন। কয়েকজন পুলিশ সদস্য কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে কাজ করতে হচ্ছে। একটু ভুল হলে এসপি স্যার বকাঝকা করেন। কিছুদিন আগে এক কনস্টেবল কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করায় তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। প্রতিদিন সকাল ৯টার দিকে গেণ্ডারিয়ার মিলব্যারাক থেকে আমাদের আসতে হয়। কাজ শেষে বিকেল ৬টার দিকে পুলিশের গাড়িতে করে আবার ঢাকায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়। ব্যারাক থেকে যে খাবার আসে তাই আমাদের খেতে হয়।’</p> <p>এক পুলিশ সদস্য আক্ষেপ করে বলেন, “অনেক স্বপ্ন নিয়ে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেই। কিন্তু তা আর পূরণ হচ্ছে না। পুলিশ সদস্য হয়ে এখন আমি হয়ে গেছি ‘রাজমিস্ত্রির হেলপার’। প্রায় দুই বছরে ধরে এসপি স্যারের বাড়ি নির্মাণ কাজে আছি। হেলপার হওয়ায় সবার মধ্যে হতাশা কাজ করছে। পুলিশের আইন অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তা ব্যক্তিগত কাজে পুলিশের কোনো সদস্যকে দিনের পর দিন কাজ করাতে পারেন না। কিন্তু এসপি স্যার সব কিছুই করাচ্ছেন।”</p> <p>স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে, এসপি সাহেব এখানে বিশাল আকারের বাগানবাড়ি তৈরি করছেন। বছর পাঁচেক আগে তিনি ওই জায়গা কেনেন।</p> <p>এ প্রসঙ্গে ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান গতকাল দুপুরে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করানো যায় না। আরআরএফের এসপি সাহেব পুলিশ সদস্যদের দিয়ে তাঁর বাড়ি নির্মাণ করাচ্ছেন, সে খবর আমি জানি না। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে তিনি গুরুতর অপরাধ করেছেন। কিছুতেই এসপি রিজার্ভ পুলিশকে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতে পারেন না। বিষয়টি তদন্ত করা হবে। এই ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।’</p> <p>অভিযোগ সম্পর্কে পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অভিযোগটি সত্য নয়। পুলিশ সদস্যদের দিয়ে কেন রাজমিস্ত্রি হেলপারের কাজ করাব? তবে কয়েকজন আমাকে সহায়তা করে। এটা দোষের কিছু নয়। আপনি সরেজমিনে এসে দেখে যেতে পারেন তা সত্য কি না।’ তখন এই প্রতিবেদক সরেজমিনে যাওয়ার কথা বললে তিনি বলেন, ‘আপনি আমার সঙ্গে দেখা করলেন না কেন? যাক ভাই এসব কথা। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আগামী শুক্রবার আপনি আমার সঙ্গে দেখা করেন। সাক্ষাতে সব কথা বলব।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভালো কাজ করলে শত্রুরা তৎপর হয়ে ওঠে। আমি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে এখানে বাড়ি করছি। এটা তো দোষের কিছু না।’ তিনি আরো বলেন, পুলিশের গাড়িতে করে কোনো নির্মাণসামগ্রী আনা হয়নি। কালের কণ্ঠ’র কাছে ছবি আছে জানাতেই তিনি কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। পরে বলেন, ‘আমি মাঝেমধ্যে এখানে আসি। নিয়মিত অফিস করতে হয়। ওই ফাঁকে হয়তো বা কোনো শ্রমিক পুলিশের গাড়ি ব্যবহার করেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘মিরপুরে আমার বাড়ি তৈরিতেও পুলিশের কোনো সদস্যকে দিয়ে কাজ করানো হয়নি। ওই বাড়িটি আমার শ্বশুরের।’ এক প্রশ্নের জবাবে এসপি মিজান বলেন, বাড়ির কাজ না করায় কোনো পুলিশ কনস্টেবলকে বরখাস্ত করা হয়নি। কেউ ইচ্ছা করে এসব অপবাদ রটাচ্ছে।</p> <p>চার বছর ধরে ঢাকার রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্সে এসপি হিসেবে আছেন মিজানুর রহমান। এর আগে তিনি বাগেরহাটের পুলিশ সুপার ছিলেন। সাভারের হেমায়েতপুর আলীপুর ব্রিজসংলগ্ন ৫৩ নম্বর জগন্নাথপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনে ৮৪ শতাংশ জমির ওপর দুই বছর ধরে বাড়ি বানাচ্ছেন তিনি। ভবনটির পূর্ব পাশে একটি গুদামও তৈরি করা হয়েছে। এর ভেতরে প্রচুর সারের বস্তা রাখা আছে।</p> <p>গত মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়ে বাড়িটির ঠিকানা জিজ্ঞেস করতেই চায়ের দোকানে বসা এক বৃদ্ধ বলেন, ‘চাচা, এসপি সাহেবের বাগানবাড়ির কথা বলছেন? ওইটা একটা বাড়ির মতো বাড়ি। পুলিশ সদস্যরাই এখানে রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন। হাতে গোনা কয়েকজন আছেন প্রকৃত রাজমিস্ত্রি।’ পরে এই প্রতিবেদক ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন, কয়েকজন পোশাকধারী পুলিশ সদস্য ঘোরাফেরা করছেন। তাঁদের মধ্যে একজন এসে জানতে চান, আপনি কে? অন্য পরিচয় দেওয়ায় পুলিশের ওই সদস্য চলে যান। পরে নির্মাণ উপকরণ তৈরিতে ব্যস্ত কয়েকজনের কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলে তাঁরা আঁতকে ওঠেন। বলেন, ‘এসপি স্যার মাঠের উত্তর কোনায় দাঁড়িয়ে কাজের তদারকি করছেন। যা বলবেন দ্রুত বলেন। না হলে আমাদের চাকরি চলে যাবে।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ভাই আর কষ্ট সহ্য হয় না। ইট মাথায় করে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় উঠতে হয়েছে।’ ওই পুলিশ সদস্যদের মধ্যে কয়েকজন আছেন বয়স্ক। তাঁদের একজন বলেন, “চাচা, আর পারছি না। দুই বছর ধরে এসপি স্যারের এখানে ‘রাজমিস্ত্রির হেলপার’ হিসেবে কাজ করছি। আমাদের তো এখানে কাজ করার কথা নয়। আমার তো দেশের খেদমত করার কথা। এসপি স্যার এখানেই বেশি থাকেন। অফিসে কম যান।” একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা বলে ওঠেন, ‘সাংবাদিক ভাই, আপনি দ্রুত ভাগেন। তা না হলে স্যার আপনার ক্ষতি করবেন।’ এ সময় ভবনের ভেতর থেকে একজন এ প্রতিবেদকের দিকে তেড়ে আসেন। বিষয়টি বুঝতে পেরে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন প্রতিবেদক। কিছুক্ষণ পর আবার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, এসপি মিজানুর রহমানের সাদা রঙের জিপ ও দুটি পিকআপ দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে একটি পিকআপে  রড রাখা।</p> <p>সূত্র জানায়, এসপি মিজানের নির্মাণাধীন বাড়িতে পুলিশের আরআরএফ শাখার প্রায় ৬০ জন সদস্য প্রতিদিন পালাক্রমে সাব-ইন্সপেক্টর আলমগীর হোসেন, সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর সিদ্দিকুর, নুরু ও রুহুল আমিনের নেতৃত্বে কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন নায়েক মোস্তাকিন, নায়েক আলী আশ্রাফ, নায়েক সেকেন্দার, কনস্টেবল জামাল, কনস্টেবল সাইদুল, কনস্টেবল মান্নান, কনস্টেবল মনির, কনস্টেবল আরিফ শেখ, কনস্টেবল নাজিম, কনস্টেবল কাউসার, কনস্টেবল মাসুদ, কনস্টেবল সাইদুর, কনস্টেবল জাহিদুল, কনস্টেবল রাধারমন, কনস্টেবল আজাদ, কনস্টেবল শাহিন, কনস্টেবল জহিরুল, কনস্টেবল ওয়ালিউল্লাহ, কনস্টেবল কামাল, কনস্টেবল মনসুর, কনস্টেবল তারেক, কনস্টেবল ফকরুল, কনস্টেবল সুজন, কনস্টেবল  সুমন, কনস্টেবল আপেল মাহমুদ প্রমুখ। তা ছাড়া প্রকৃত রাজমিস্ত্রি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আমিনুল, শামীম ও মনু মিয়া। তাঁদের রোজ হিসাবে টাকা দেওয়া হয়।</p> <p>পুলিশের এক সদস্য বলেন, ‘সারা দিনে একটিবারের জন্যও কিছু খাওয়ান না এসপি স্যার। ব্যারাক থেকে যে খাবার আসে তাই আমরা খাই। এসপি স্যার মিরপুরের মাজার রোডে আলমাস টাওয়ার ও পলাশ স্টিল মিলের পাশে আরেকটি ভবনের কাজও আমাদের দিয়ে করাচ্ছেন। জগন্নাথপুরের কাজের জন্য মিরপুরের কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।’ তিনি আরো জানান, কাজ না করায় কিছুদিন আগে কনস্টেবল সাইফুল ইসলামকে (কনস্টেবল নম্বর-৭৪৫) সাময়িক বরখাস্ত করেন এসপি স্যার।</p> <p>পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশ প্রবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, পুলিশের প্রতিটি সদস্য প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তাঁদের দিয়ে ব্যক্তিগত কাজ করানো যাবে না। এসপি সাহেব যা করেছেন তা সম্পূর্ণ অনৈতিক। বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্ত করে দেখা উচিত।</p> <p>গতকাল সন্ধ্যায় ঘটনাস্থল থেকে পুলিশের এক সদস্য বলেন, ‘এসপি স্যার আমাদের বলেছেন, এক সাংবাদিক ফোন করেছিল। নিউজ হতে পারে। কয়েক দিন কাজ বন্ধ রাখা ভালো। এ কদিন তোমরা রেস্টে থাকো। এই বলেই বিকেলে তিনি আমাদের ছুটি দিয়েছেন।’</p>