X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

হাসপাতালে চিকিৎসা মেলেনি অন্তঃসত্ত্বার: রাস্তায় প্রসবের পর শিশুর মৃত্যু

আমানুর রহমান রনি
১৮ অক্টোবর ২০১৭, ০৪:৫৯আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০১৭, ১১:৪৪

রাস্তায় পড়ে থাকা প্রসূতি মা পারভীন বেগম রাজধানীর তিনটি হাসপাতালের কোথাও এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর চিকিৎসা মেলেনি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে পারভীন বেগম নামের ওই নারীকে চিকিৎসা না দিয়ে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কর্তব্যরত চিকিৎকরা।  রাজধানীর দু’টি হাসাপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে শেষপর্যন্ত আজিমপুর ‘মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে’ গিয়েও চিকিৎসা মেলেনি ওই নারীর। এরপর ওই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সামনের রাস্তায় সন্তান প্রসব করেন তিনি। এর কিছুক্ষণ পরই মৃত্যু হয় শিশুটির। পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী, চিকিৎসক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিচালক ও ভুক্তোভোগী প্রসূতি নারীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

এ ঘটনার তদন্তে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিচালক (এস সি এইচ সার্ভিসেস) একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন।

মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর আজিমপুর ‘মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান’-এর সামনে ঘটনাটি ঘটে। পারভীন বেগমের গ্রামের বাড়ি যশোরে। কয়েক মাস আগে তার স্বামী তাকে ফেলে চলে যান। এরপর গুলিস্তানের গোলাপশাহ মাজারে তার আশ্রয় হয়। সেখানেই তিনি ছিলেন। মঙ্গলবার ভোররাতে তার প্রসব বেদনা শুরু হয়। এরপর সোহেল নামের এক যুবক তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন।  

মঙ্গলবার সোহেল সাংবাদিকদের জানান, ‘পারভীন আমার হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার অনুরোধ করেন। তখন তাকে প্রথম একটি সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে পরীক্ষা করে বলেন, তার স্বাভাবিক ডেলিভারি হবে। চিন্তার কারণ নেই। কিন্তু কিছুক্ষণ পর তারা আবার পরীক্ষা করে জানান, পারভীনের সিজার করতে হবে। তার অবস্থা সংকটাপন্ন। তারা বলেন, তাদের হাসপাতালের সিজারের ভালো চিকিৎসক নেই। তারা অন্য একটি হাসপাতাল দেখিয়ে দেয়। সেখানে গেলে ওই হাসপাতালের চিকিৎসকরা পারভীনকে আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিয়ে যেতে বলেন।’

এরপর  সকাল সোয়া ৮টার দিকে মাতৃসদন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানে যান পারভীন ও সোহেল। কিন্তু সেখানে তার নামে কার্ড কিংবা রেজিস্ট্রেশন না থাকায় তারা পারভীনকে ভর্তি করবে না  জানানো হয়। সোহেল বলেন, ‘এ সময় পারভীন প্রসব বেদনায় ছটফট করতে থাকেন। এরপর তাকে দ্বিতীয় তলার লেবার রুমে নিয়ে যাই। তখন লেবার রুমে কনসালটেন্ট ডা. নিলুফা দায়িত্বরত ছিলেন। ’ তিনি আরও  বলেন, ‘লেবার রুমে নেওয়ার পর এক নারী চিকিৎসক এসে বলেন, পারভীনকে সিজার করতে হবে। ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা লাগবে। তোমাদের কাছে কত টাকা আছে? তখন আমাদের কাছে টাকা নেই বলে জানাই। এর কিছুক্ষণ পর হাসপাতালের পোশাক পরা এক আয়া এসে পারভীনের হাত ধরে নিচে নামিয়ে নেন। তখন পারভীনের ব্যথা আরও বেড়ে যায়। হাঁটতে পারছিলেন না। নিচে আনার পর পারভীন ৪-৫ পা যেতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকেন। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী, স্বজন ও রাস্তা দিয়ে যাওয়া পথচারীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। পারভীনকে কোনও রকম দাঁড় করানোর পর আবার ৩-৪ পা যেতেই তিনি আবার মাটিতে পড়ে যান। এ সময় হঠাৎ করে তার সন্তান প্রসব হয়। পরে আশপাশের কয়েকজন মহিলা এসে চারদিকে কাপড় ধরে কাজটি শেষ করেন। পুত্র সন্তানটি একজন হাতে নেন। শিশুটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর প্রায় দুই মিনিটের মতো হাত-পা নাড়াচ্ছিল। তখনও হাসপাতালের গেটে ও দো-তলার জানালের কাছে দাঁড়িয়ে কয়েকজন নারী ডাক্তার, নার্স ও দারোয়ান বিষয়টি দেখছিলেন। কেউ এগিয়ে আসেননি। মিনিট দুয়েক পর শিশুটির দেহ হঠাৎ নিস্তেজ হয়ে যায়।’

সোহেল মিয়া বলেন, ‘শিশুটি মারা যাওয়ার পর প্রত্যক্ষদর্শীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারা চিৎকার শুরু করে গণমাধ্যমকর্মী ও পুলিশকে জানানোর কথা বললে হাসপাতালের দুই জন স্টাফ একটি ট্রলি নিয়ে এগিয়ে এসে পারভীনকে নিয়ে একটি রুমে চিকিৎসা দেন। তারা শিশুটিকে নিতে চাইলে প্রত্যক্ষদর্শীরা দেননি। তারা বলেন, এখানে পুলিশ কর্মকর্তা ও সাংবাদিকরা আসবেন। তারা নিজ চোখে এসব দেখার পর তাকে দেওয়া হবে। এভাবে প্রায় ৪০ মিনিটের মতো শিশুটির নিথর দেহ কনক্রিটের ওপর পড়ে থাকে। ’

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী মিলন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি সেখানেই ছিলাম। অনেক মানুষ ছিল সেখানে। হাসপাতালের নিচে আমি ওই নারীকে শুয়ে থাকতে দেখেছি। এ সময় অনেক নারী তাকে ঘিরে ছিলেন। তার সঙ্গে যে ছেলেটি ছিল, সে আমার মোবাইল নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ফোন দেয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিছুক্ষণ পরে সেখানে পুলিশ, র‌্যাব ও চিকিৎসকরা আসেন। তারা আসার পর ওই নারীকে মাতৃসদনের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়।’

মাতৃসদনের তত্ত্বাবধায়ক ডা. ইশরাত জাহানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই রোগী আসার পর তাকে লেবার রুমে শোয়ানো হয়। নিয়ম অনুযায়ী টয়লেট করতে ও হাঁটা-চলা করতে বলা হয়। এ সময় এক নারী ওই রোগীকে বলে, ১ হাজার ৫০০ টাকা হলে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এই বলে তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় ঘটনাটি ঘটে। ওই মহিলা দালাল চক্রের সদস্য। তারপরও গেটে দারোয়ান থাকতে কিভাবে ঘটনাটি ঘটলো তা দেখা হবে।’

এ ঘটনায় গাইনি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. হোসনে আরা জাহানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদনও দিতে বলা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ডা. ইশরাত জানান  বলেন, ‘পারভীন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

মাতৃসনদ ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিচালক (এস সি এইচ সার্ভিসেস) ডা. মোহাম্মদ শরীফ। ঘটনার বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ছুটে যাই। সেখানে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। কিভাবে ওই নারীকে মাতৃসদন থেকে বের করা হয়েছে, তাও তদন্ত করে বের করেছি। এর সঙ্গে কে জড়িত, তাও মহাপরিচালকে জানানো হয়েছে।’

ডা. মোহাম্মদ শরীফ বলেন, ‘মাতৃসদনে আসার পর পারভীনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তিনি নিজে বাথরুমে গেছেন। এর মধ্যে এক নারী তাকে পাশের একটি ক্লিনিকে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এখানে অনেক দালাল রয়েছে। আমরা বাইরের দালাল প্রতিরোধ করতে পারলেও যারা হাসপাতালে কর্মরত, তারাও ওই দালালদের সঙ্গে মিলে কাজ করেন। তাদের আমরা প্রতিরোধ করতে পারি না। আমি ঘটনার পর গিয়ে সবাইকে ডেকেছি। ওই নারীর সামনে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি, কারা তাকে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের চেনেন কিনা? এরপর পারভীন এক নারীকে দেখিয়ে দিয়েছেন। যার নাম শাহেদা। তিনি মাতৃসদনের আয়া। এই আয়াই পারভীনকে হাসপাতাল থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার সময় পথে তার প্রসব হয়। আমি বিষয়টি মহাপরিচালককে জানিয়েছি। এছাড়া আমিও একটি তদন্ত দল গঠন করে দিয়েছি। ওই কমিটির সদস্যরা তিন দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেবেন।’

লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ঘটনার পর আমাদের পুলিশ সেখানে ছিল। তবে এখনও এবিষয়ে কেউ কোনও অভিযোগ করেনি। ওই নারী মাতৃসদনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

 

/এমএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
রংপুর হাসপাতালে বাড়ছে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী, ৫ দিনে ২২ জনের মৃত্যু
রংপুর হাসপাতালে বাড়ছে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী, ৫ দিনে ২২ জনের মৃত্যু
তুর্কি মিডফিল্ডারের গোলে শিরোপার আরও কাছে রিয়াল মাদ্রিদ
তুর্কি মিডফিল্ডারের গোলে শিরোপার আরও কাছে রিয়াল মাদ্রিদ
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!